এ কে এম শাহ্জাহান
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন গণমানুষের নেতা। শিবপুরের মাটি ও মানুষের আপজন। শিবপুর বাসীর আশা—আকাঙ্খার আশ্রয়স্থল ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তাঁর চেতনার অন্তর্গত স্বপ্ন, দারিদ্র ও শোষণ নির্যাতন মুক্ত সত্যিকার বাংলাদেশ আজও পায়নি জনগণ। তার জন্মস্থান ও তারিখ নিয়ে কিছু বিদ্রোহ লক্ষ করা যায়। তাই আবদুল ম্নানান ভূঁইয়ার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “জীবন ও সংগাম” থেকে তাঁর নিজের ভাষায় “নরসিংদীর শিবপুর থানার মাছিমপুর আমার পৈত্রিক বাড়ী হলেও আমার জন্ম হয় নানার বাড়ী মনোহরদীর আসাদনগরে, ১৯৪৩ সালের ১লা মার্চ।
তৎকালীন সময়ে সন্তানের জন্মের সময় মা’কে তার বাবার বাড়িতে অবস্থান ছিল প্রচলিত প্রথা। বিশেষ করে প্রথম সন্তানের বেলায়। আমিই ছিলাম আমার বাবা—মার প্রথম ও শেষ সন্তান। আমার জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই আমার বাবা আবদুল হাই ভূঁইয়া ইন্তেকাল করেন। মা রহিমা আখাতরকে অবলম্বন করেই আমি বড় হতে থাকি। আমার বাবা ছিলেন দাদার দ্বিতীয় সন্তান। আমার জ্যাঠার অনেক দিন কোন সন্তান ছিল না। আমিই একমাত্র শিশু। তাই দুই পরিবারের প্রচুর আদর যত্নে আমি বড় হতে থাকি।
বাড়িতেই ছিল প্রাইমারী স্কুল। প্রাইমারী পাস করে ভর্তি হলাম দুলালপুর হাই স্কুলে। তখন এটি ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত মাইনর হাই স্কুল। প্রধান শিক্ষক ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্ব। তিনিই তাঁর মাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে এই স্কুলে নিয়ে এলেন। দুলালপুর স্কুলে পড়াকালীন বরাবরেই তিনি ফাস্ট হতেন। সে কালে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্যসব বইকে ‘আউট বই’ বলা হতো। অভিভাবগণ ‘আউট বই’ পড়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু তিনি ঐ সময়ই খুবই আগ্রহ সহ ‘আউট বই’ পড়তেন বলে স্বীকার করছেন। তাঁর ভাষায় “রবীন্দনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, সৈয়দ মুজতবা আলী সহ অনেকের বই পড়তাম লুকিয়ে লুকিয়ে। এগুলো আমাকে জীবনের শুরুতেই আলোকিত হতে এবং রেজাল্ট ভালো করতে সাহায্য করে। আমার সে অভ্যাস আজও রয়েছে। যতই ব্যস্ত থাকি না কেন ২৪ ঘন্টার অন্তত দুই ঘন্টা আমি সবসময়ই পড়ার পিছনে কাজে লাগাই। আমার এই অভ্যাস সঞ্চারিত হয়েছে আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও।
অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত দুলালপুর স্কুলে পড়ে নাইনে উঠেই শিবপুর হাই স্কুলে ভর্তি হন, লেখাপড়া ও খেলাধুলা নিয়মিত চলছে। নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উঠার সময় রেজাল্টও আশাতীত ভাল হয়। প্রথম পাঁচজনের মধ্যে চলে আসেন তিনি। কিন্তু এ সময়ই তাঁর জীবনে নেমে আরেক দূরভাবনা। নিজের ভাষায় “আমার জীবনে নেমে আসে আরেক চরম দূভার্গ্য। আমার মা মৃত্যুবরণ করেন। একেবারেই একা হয়ে যাই। মা—বাবা, ভাই—বোন কেউ নেই। ভেঙ্গে পড়লাম না। আমার চাচারা এগিয়ে এলেন আরো কাছে।”
১৯৫৮ সালে শিবপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্টিকুলেশন পাস পাস করেন। ১৯৬০ সনে নরসিংদী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহিমুল্লাহ হালের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ইতিহাসে বিএ (অনার্স) ও ১৯৬৫ সালে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল ‘ল’ কলেজ তেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। আবদুল মান্নান ভূইয়া কলেজ জীবনেই ছিলেন অত্যন্ত সচেতন ও ন্যায় নিষ্ঠ ছাত্র। নরসিংদী কলেজে অধ্যয়ন কালেই ‘প্রগতি সংঘ’ থেকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে কলেজ ছাত্র সংসদে সমাজ সেবা সম্পাদক পদে জয়লাভ করেন। উল্লেখ্য ভিপিসহ অধিকাংশ পদেই প্রগতি সংঘের প্রার্থীরাই জয়লাভ করেন।
তখন ১৯৬৪ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হন এবং কারাগার বরণ করেন। ১৯৬৬ সনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ষাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে ভাষাণী ন্যাপে যোগদান করেন এবং ১৯৬৯ সনে গণ—অভ্যূত্থানে নেতৃত্বদান করেন। ’৬৯ এর গণ—অভ্যূত্থানের মহান শহীদ আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন তাঁর সভাদশের অনুসারী। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকেই শিবুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। ৮ মার্চেই শিবপুর হাই স্কুল মাঠে প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরাই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। ২৫ মার্চ শিবপুর হাই স্কুল মাঠে বিকিলে জনসভা করেন। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। শিবপুরের মাটিতেই জনসাধারণের মাঝে থেকে অসীম সাহসীকতায় পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করেন। শিবপুরের জনতা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই বিজয়ের উল্লোসে চারিদিক মুখরিত করে তোলে। ৭ ডিসেম্বর ভোর রাতের পুটিয়ার সর্বশেষ যুদ্ধের মাধ্যমে শিবপুর “হানারদার মুক্ত” হয়। তাই ৮ ডিসেম্বর “শিবপর মুক্ত দিবস”। বীর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জনাব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া জনগণের মহান নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন।
অবৈধ স্বৈচারার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সনের ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচার পতি সাহাব উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ জাতীয়তা বাদী দল (বিএনপি) প্রধান ও জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন এবং ১১ কেবিনেট ও ২১ জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে একাই মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। উক্ত পরিষদে আবদুল মান্নান ভূইয়া পাট প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৮ সানে ইউপিপি’র সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮০ তে বিনএপিতে যোগদান করে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে বিনএপি’র যুগ্ম মহাসচিব ও ১৯৯৬ সালে বিএনপি’র মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন—এর সময়ে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করলে বিএনপি থেকে বহিষ্কার হন।
আবদুল মান্নান ভূঁইয়া শিক্ষকতার সাথেও জড়িত ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। এরই প্রিয় সহকর্মীও সহযোদ্ধা আসাদ এর শাহাদাতের পর শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বার বার নরসিংদী—৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে মরণ ব্যাধি ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। দেশ বিদেশে চিকিৎসার পর সর্বশেষ ০৭ জুলাই সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং আইসিইউতে ২০ দিন থাকার পর ২০১০ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশের রাজনীতির এক তারকা পুরুষ, গণমানুষের অত্যন্ত প্রিয়নেতা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া পবিত্র শবে বরাতের রাত ১২টা ০২ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শহীদ আসাদ কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় পাঁচ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। বিপুল সংখ্যক জনগণের ভালবাসায় সিক্ত হলেন অন্তিম শয়ানে আবদুল মান্নান ভূঁইয়া।
প্রতি বছর এদিনে শিবপুরের স্কুল—কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিবপুরের বিভিন্ন সংগঠন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া পরিষদসহ আপামর জনগণ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে থাকেন। এ উপলক্ষ্যে শিবপুরের জনগণের আকুল আবেদন, সেই একক ব্যক্তিত্ব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন ধাপে যিনি জীবন বাজি রেখে জনগণের মঙ্গলের চিন্তায় বিভোর ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। সচল, সজীব বাংলাদেশের স্থির প্রতিকৃতি দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার করকসলে বিএনপি থেকে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বহিষ্কার আদেশটি মরনোত্তর প্রত্যাহার…….।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অগ্রগতি, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সর্বজন গ্রাহ্য একটি সাংস্তৃতিক কাঠামো গণতান্ত্রিক চেতনা, সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ এটাই ছিল আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার স্বপ্ন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশনায় তারুণ্যের অহংকার তারেক জিয়ার নেতৃত্বে প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে শিবপুরবাসী দৃঢ়—সংকল্পবদ্ধ।
লেখক: সাবেক জেলা শিক্ষা অফিসার
শিক্ষা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।





