নিজস্ব প্রতিবেদক
‘ জুলাই এর প্রেরণা, দিতে হবে ঘোষণা ‘-বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী লিফলেট বিতরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৮ জানুয়ারি নরসিংদী জেলার ইটাখোলার মোড় , জেল খানার মোড় ও মাধবদীতে ঘোষণাপত্রে ৭দফা অন্তর্ভূক্তির জন্য জনসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেন জুলাই আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মহানায়ক মূখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম। তার সাথে ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জাফরিন সুলতানা জেসি, মুনমুন মম , শাহাদাত হোসেন , নরসিংদীর শহীদ তাহমিদের বাবা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত তমাল, সোহান হায়দার, জান্নাতুল ফেরদৌস মালিহা, মাসুদ হাকিম, আকিক,আবদুল্লাহ আল মারুফ, সিয়ামসহ অনেকে।
ঘোঘণা পত্রে দাবি সম্মলিত লিফলেটটি নিম্মরূপঃ সংগ্রামী ছাত্র-জনতা, সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছা ।
গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ একটি নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়া শাসনের অধীনে চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
অবৈধ আওয়ামীলীগ সরকার জনগণের সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে এসেছিল ঘোরতর এক বিপর্যয়। কর্মসংস্থান ছিল না, চাকরিতে ছিল দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি সহ নানা দুর্নীতি; ছিল না কথা বলার অধিকার। দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা। গুম, খুন, ক্রসফায়ার, বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দি, আলেম সমাজ ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর অমানবিক নির্যাতনের মতো ভয়াবহ সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এ কাজে তারা রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার্যত তিনটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল। আওয়ামী অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা বারবার রাস্তায় নেমেছে। গত জুলাই- আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারকে উৎখাত করেছে। স্বৈরাচারী হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কুখ্যাতি অর্জন করেন। পালিয়ে যাওয়ার আগে দুই হাজারের মতো মানুষকে হত্যা, প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের অঙ্গহানী করেছে খুনী হাসিনা ও তার দল।
গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাখো জনতার উপস্থিতিতে এক দফা ঘোষণা করা হয়। সেখানে খুনি হাসিনার পতনের পাশাপাশি ছাত্র- জনতা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপেরও অঙ্গীকার করে। এর সহজ অর্থ হচ্ছে, আর কোনো শাসক ক্ষমতায় গিয়ে যেন হাসিনার মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে সেরকম রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
শহীদ মিনারে ঘোষিত এক দফার ভিত্তিতে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার উৎখাত হয় যা সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এশিয়াসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে মুক্তিকামী জনগণের জন্য বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান এক নতুন দিশা ও প্রেরণা। দুনিয়ার যেখানেই মুক্তিকামী জনগোষ্ঠী স্বৈরাচার উৎখাত করেছে কিংবা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেছে সেখানেই অভ্যুত্থানের শক্তি এ ধরনের ঐতিহাসিক অর্জনকে স্বীকৃতি দিতে জনগণের সামনে ঘোষণাপত্র তুলে ধরেছে। ফরাসি বিপ্লব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আলজেরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিপ্লবী জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে আমরা এ ধরনের নজির দেখেছি। নিপীড়িত ও মজলুম জনগোষ্ঠীর লড়াই হিসেবে আমরাও জনগণের সামনে এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি, যেন ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে সুরক্ষিত থাকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত এই অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানকে টিকিয়ে রাখতে এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে শুরু থেকেই আমরা একটি প্রোক্লেমেশন তথা ঘোষণাপত্র জারির দাবি জানিয়ে এসেছি। এ ঘোষণাপত্রই হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার উৎস এবং পরবর্তী সংবিধানের ভিত্তিমূল। জনগণের বিপুল সাড়া ও চাপের মুখে সরকার নিজে এ ঘোষণাপত্র জারির ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করতে বাধ্য হয়। আমরা অনতিবিলম্বে এ ঘোষণাপত্র জারির দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখতে চাই।
আপনারা জানেন, ইতিমধ্যে আমরা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সরকারকে ১৫ দিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র জনগণের সামনে তুলে ধরার সময় বেঁধে দিয়েছি। আমরা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করার জন্য জোরালো দাবি জানাচ্ছি। উক্ত ঘোষণাপত্রে এ জনগোষ্ঠীর বিগত দুইশত বছরের লড়াই-সংগ্রামের স্বীকৃতি থাকতে হবে। বিগত ১৬ বছরের জুলুম-নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করাসহ অর্থ পাচারের খতিয়ান থাকতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র- জনতার জুলাই অভ্যুত্থান এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। যার মাধ্যমে আওয়ামীলীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চেতনা ব্যবসার অবসান ঘটে। ফলে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আপামর জনগণের অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়।
তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে ভয়াবহ এই ফ্যাসিবাদী জিজির ছিন্ন করেছে ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ থাকতে হবে। আমরা চাই অধিকার, ইনসাফ ও মর্যাদাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র। ব্যক্তি ও সমাজের সহাবস্থানে বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক এক রাষ্ট্রকল্প যেখানে ভোটাধিকারসহ সকল মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। বাহাত্তর-পচাত্তরের একদলীয় শাসন এবং এক- এগারোর বিরাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠন করার সংকল্প ব্যক্ত করবে এই ঘোষণাপত্র।
ঘোষণাপত্রে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি:
জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে আহতদের বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুচিকিৎসা প্রদানের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করতে হবে
অভ্যুত্থানে আওয়ামী খুনী ও দোসরদের বিচার নিশ্চিত করার স্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে
ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি সংবিধান বাতিল করে নির্বাচিত গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে।
ঘোষণাপত্রে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর নেতৃত্ব পরিস্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে
১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা পরিস্কার করতে হবে
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের মধ্য দিয়ে নাগরিক পরিচয় প্রধান করে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের একমাত্র প্রধান লক্ষ্য আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাত করা ছিল না; বরং গত ৫৩ বছরের বৈষম্য, শোষণ ও ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলোপ করার লক্ষ্যে এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিলোগ করতে সব ধরনের সংস্কারের ওয়াদা দিতে হবে
সবশেষে, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রাজনীতিকে শক্তিশালী করুন।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।