শরীফ ইকবাল রাসেল

নরসিংদীতে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষে তাহমিদ ভূইয়ার মৃত্যুতে ফুসে উঠছিল নরসিংদীর ছাত্রজনতা। পুলিশের গুলিতে ওই দিন ঝাঝড়া হয়ে গিয়েছিল তাহমিদের বুক। আর এই খবর ছড়িয়ে পরার সাথে সাথেই সমস্ত নরসিংদীর ছাত্র জনতার পাশাপাশি অভিভাবকরা একাত্মতা প্রকাশ করে।

১৮ জুলাই পূর্ব নির্ধারিত বেলা ৩টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করতে জড়ো হতে থাকে ছাত্ররা। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে নরসিংদী জেলখানা মোড়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনের একটি মিছিল নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জেলখানা মোড়ে প্রবেশ করেন। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। এরপর জেলখানা মোড়ে চারদিক থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা নরসিংদী-ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। সংঘর্ষে তাহমিদের বুক পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

নিহত তাহমিদ ভূইয়া নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর নন্দীপাড়া এলাকার পল্লী চিকিৎসক রফিকুল ইসলামের ছেলে ও নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সোহান হায়দার জানায়, ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচীতে পুলিশ অতর্কিত হামলা করে গুলি চালায়। নির্বিচারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ ও গুলি করে। এতে তাহমিদ গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে ধরে ১০০শয্যা বিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষনা করেন। এঘটনায় তাহমিদ ভূইয়া ছাড়াও নিহত হয় ইমন হোসেন, অনিকসহ বেশ কয়েকজন এবং অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী আহত হয়। আহতদের ১০০ শয্যা বিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাহমিদকে মৃত ঘোষণা করে।

তাহমিদের নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের প্রধান শিক্ষক মো. ইমন হোসেন জানান, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) স্কুল বন্ধ ছিলো। তাহমিদ ভূইয়া কোটাবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে জেলখানা মোড় এলাকায় গুলিতে নিহত হয়। সে চিনিশপুর নন্দীপাড়া এলাকার পল্লী চিৎিসক রফিকুল ইসলামের ছেলে। তার মায়ের নাম তায়্যিবা ভূইয়া। সে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার মৃত্যুতে স্কুলে শোক পালন করা হয়।

১৮ জুলাইয়ের নিহত তাহমিদের মৃত্যুর বিষয়ে নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মিজানুর রহমান জানান, ওইদিন প্রায় ৪টার দিকে নিহত তাহমিদকে হাসপাতালে আনা হয়। তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। বিকেল ৪ টা থেকে পৌনে ৬টা পর্যন্ত আহত ছাত্রদেরকে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

তাহমিদের বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, কিশোর তাহমিদ তিন ভাই বোনের মধ্যে বড় এবং বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান। যার ফলে সে অনেকটা ডানপিঠে ছিলো। লেখাপড়ার ফাঁকে সময় পেলেই ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠতো। তাই তার স্বপ্ন ছিলো একজন ক্রিকেটার হবে। কিন্তু সেই্ স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেলো। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মুহূর্তেই নিভে গেল তাহমিদের সেই স্বপ্ন। নরসিংদী মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকের শহিদ মিনারের সামনে আন্দোলনকারীরা স্বৈরাচারবিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে। তখন পুলিশ তাহমিদের মরদেহের ওপর গুলি চালায়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মরদেহের ময়নাতদন্ত করার জন্য বলা হলে তাতে রাজি না হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই ঘটনার দিন রাতেই চিনিশপুর ঈদগাহ মাঠে দুই দফা জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে তাহমিদকে দাফন করে দিতে হয়েছে। সবার সামনেই গুলি করে ছেলেকে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, ময়নাতদন্ত করে আর কী হবে? তাহমিদ তো আর ফিরে আসবেনা।

তিনি আর জানান, তার স্বপ্ন ছিলো বিকেএসপিতে ভর্তি হবে। নিজেকে দেশের একজন বড় ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তুলবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। একমাত্র ভাই তাহমিদের মৃত্যুতে অনেকটাই নির্বাক হয়ে গেছে ছোট বোন লিনাত ভূঁইয়া। সারাক্ষণ শুধু ভাইয়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে।

তাহমিদের বাবার কাছে পুত্রের মৃত্যুদিনের স্মৃতিচারণে তিনি জানান, মারা যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেও পরিবারের সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খেয়েছে। দুই ভাইবোন বিছানায় শুয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে খেলা করেছে। পরে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যায়। তখন তার মা রান্না ঘরে কাজ করছিলেন বাবা তখন ঘুমাচ্ছিলেন। সেই ফাকে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় তাহমিদ। তাহমিদ বাইরে বেরুতে চাইলে মা বাধাও দিয়েছিলেন। এসময় কথার এক পর্যায়ে মাকে তাহমিদ বলে, তুমি আমাকে কোথাও যেতে দাও না, মেয়ে মানুষের মত ঘরে বসিয়ে রাখ। মায়ের সাথে এটাই শেষ কথা তার। মায়ের সাথে কথা বলতে বলতেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তাহমিদ। ছাত্র-জনতা শহিদ তাহমিদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে চান। তাদের দাবি, নরসিংদীর জেলখানা মোড় চত্ত্বর হবে “তাহমিদ চত্বর”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *